চট্টগ্রামের রসনাবিলাস: রেসিপিসহ সেরা ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধানে

 চট্টগ্রামের রসনাবিলাস: রেসিপিসহ সেরা ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধানে

চট্টগ্রামের রসনাবিলাস রেসিপিসহ সেরা ৫টি জনপ্রিয় খাবারের সন্ধানে

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেবল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রই নয়, এটি বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ এক খাবারের সংস্কৃতির পীঠস্থান। এখানকার খাবারের স্বাদ আর ঐতিহ্যের গল্প ছড়িয়ে আছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহুদূর পর্যন্ত। ঝাল, ঝোল আর মসলার জাদুতে চট্টগ্রামের খাবার ভোজনরসিকদের নিয়ে যায় এক অন্য জগতে। আজ আমরা চট্টগ্রামের এমনই পাঁচটি জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী খাবার এবং তার সহজ রেসিপি নিয়ে আলোচনা করব, যা আপনি ঘরে বসেই তৈরি করে নিতে পারবেন।

১. মেজবানি মাংস: চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি

চট্টগ্রামের নাম নিলেই যে খাবারটির কথা সবার আগে মনে আসে, তা হলো মেজবানি মাংস। যেকোনো সামাজিক বা পারিবারিক অনুষ্ঠানে এই পদের উপস্থিতি অপরিহার্য। এর অনন্য স্বাদ আর রাজকীয় রান্নার পদ্ধতির পেছনে রয়েছে বহু বছরের ঐতিহ্য।

মেজবানি মাংসের ইতিহাস ও সংস্কৃতি:

"মেজবান" একটি ফারসি শব্দ, যার অর্থ অতিথি আপ্যায়নকারী। চট্টগ্রামের মানুষ অতিথিপরায়ণ হিসেবে পরিচিত এবং এই মেজবানি আয়োজন তাদের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঐতিহ্যগতভাবে, মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মদিন, আকিকা বা যেকোনো বড় অনুষ্ঠানে মেজবানের আয়োজন করা হয়। বিশাল আকারের পাত্রে বিশেষ মসলার মিশ্রণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রান্না করা হয় এই মাংস, যা এর স্বাদকে করে তোলে অতুলনীয়।

রেসিপি:

উপকরণ:

  • গরুর মাংস (হাড়সহ): ২ কেজি
  • পেঁয়াজ কুচি: ২ কাপ
  • আদা বাটা: ৩ টেবিল চামচ
  • রসুন বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ১.৫ টেবিল চামচ
  • মরিচ গুঁড়া: ২ টেবিল চামচ (স্বাদমতো)
  • ধনিয়া গুঁড়া: ২ টেবিল চামচ
  • জিরা গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ
  • সরিষার তেল: ১.৫ কাপ
  • লবণ: স্বাদমতো
  • গরম মসলা (এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ): পরিমাণমতো
  • তেজপাতা: ৩-৪টি
  • বিশেষ মেজবানি মসলা: ২ টেবিল চামচ (বাজারে কিনতে পাওয়া যায় বা ঘরেও তৈরি করা যায়)
  • কাঁচা মরিচ: ৭-৮টি

প্রস্তুত প্রণালী: ১. মাংস ভালো করে ধুয়ে পানি ঝরিয়ে নিন। ২. একটি বড় পাত্রে মাংসের সাথে পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা, হলুদ-মরিচ-ধনিয়া-জিরা গুঁড়া, লবণ, গরম মসলা, তেজপাতা এবং অর্ধেক সরিষার তেল দিয়ে ভালোভাবে মাখিয়ে ৩০ মিনিটের জন্য মেরিনেট করে রাখুন। ৩. চুলায় একটি বড় হাঁড়ি বসিয়ে বাকি তেল গরম করুন। তেল গরম হলে মেরিনেট করা মাংস দিয়ে দিন এবং উচ্চতাপে কিছুক্ষণ কষিয়ে নিন। ৪. মাংস থেকে পানি বের হতে শুরু করলে চুলার আঁচ মাঝারি করে দিন এবং ঢাকনা দিয়ে রান্না করুন। ৫. মাংস কিছুটা সেদ্ধ হয়ে এলে এবং তেল উপরে ভেসে উঠলে বিশেষ মেজবানি মসলা দিয়ে ভালো করে নেড়ে দিন। ৬. পরিমাণমতো গরম পানি যোগ করে আবারও ঢাকনা দিয়ে দিন এবং মাংস পুরোপুরি সেদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। ৭. ঝোল ঘন হয়ে এলে কাঁচা মরিচ দিয়ে কিছুক্ষণ দমে রেখে নামিয়ে ফেলুন। গরম ভাত বা নানের সাথে পরিবেশন করুন চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি মাংস।

২. কালো ভুনা: ঝাল আর মসলার এক অনবদ্য সৃষ্টি

চট্টগ্রামের আরেকটি বিখ্যাত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার হলো কালো ভুনা। এর গাঢ় কালো রঙ এবং ঝাল স্বাদের জন্য এই খাবারটি মাংসপ্রেমীদের কাছে এককথায় অসাধারণ।

কালো ভুনার বিশেষত্ব:

ধৈর্য এবং সময় নিয়ে রান্না করা এই পদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর রঙ এবং শুকনো ভাজা ভাজা ভাব। বিভিন্ন ধরনের ভাজা মসলার ব্যবহার এবং দীর্ঘ সময় ধরে রান্না করার ফলেই এর স্বতন্ত্র স্বাদ ও রঙ তৈরি হয়।

রেসিপি:

উপকরণ:

  • গরুর মাংস: ১ কেজি (ছোট টুকরো করা)
  • পেঁয়াজ কুচি: ২ কাপ
  • আদা বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • রসুন বাটা: ১.৫ টেবিল চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • মরিচ গুঁড়া: ১.৫ টেবিল চামচ
  • জিরা গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ
  • ধনিয়া গুঁড়া: ১ টেবিল চামচ
  • গরম মসলা গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • সয়াবিন তেল: ১ কাপ
  • লবণ: স্বাদমতো
  • শুকনো মরিচ: ৫-৬টি
  • বিশেষ মসলা (জিরা, ধনিয়া, রাঁধুনি, মৌরি একসাথে হালকা ভেজে গুঁড়ো করা): ১ টেবিল চামচ

প্রস্তুত প্রণালী: ১. মাংসের সাথে অর্ধেক পেঁয়াজ কুচি, আদা-রসুন বাটা, হলুদ-মরিচ-ধনিয়া-জিরা গুঁড়া, গরম মসলা এবং লবণ দিয়ে ভালো করে মাখিয়ে নিন। ২. একটি কড়াইতে তেল গরম করে বাকি পেঁয়াজ কুচি এবং শুকনো মরিচ দিয়ে সোনালি করে ভেজে নিন। ৩. এবার মেরিনেট করা মাংস দিয়ে উচ্চতাপে ১০-১২ মিনিট ভাজুন। ৪. মাংসের রঙ বদলাতে শুরু করলে সামান্য গরম পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিন এবং অল্প আঁচে রান্না করুন। ৫. মাংস সেদ্ধ হয়ে পানি শুকিয়ে গেলে, বিশেষ ভাজা মসলার গুঁড়ো দিয়ে দিন এবং ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। ৬. মাংসের রঙ কালো হয়ে আসা পর্যন্ত ভাজতে থাকুন। খেয়াল রাখতে হবে যেন পুড়ে না যায়। ৭. তেল উপরে ভেসে উঠলে এবং মাংস ভাজা ভাজা হয়ে গেলে নামিয়ে নিন। পরোটা, নান বা গরম ভাতের সাথে এই ঝাল কালো ভুনা খেতে অসাধারণ লাগে।

৩. দুরুস কুরুস: আস্ত মুরগির রাজকীয় পদ

চট্টগ্রামের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী এবং কিছুটা ভিন্নধর্মী খাবার হলো 'দুরুস কুরুস' বা আস্ত মুরগির রোস্ট। বিয়েবাড়ি বা বিশেষ অতিথি আপ্যায়নে এই পদের জুড়ি মেলা ভার।

দুরুস কুরুসের ঐতিহ্য:

'দুরুস' শব্দটি সম্ভবত 'পুরো' বা 'আস্ত' বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। আস্ত মুরগিকে মসলা মাখিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে রান্না করা হয় বলে এর স্বাদ সাধারণ মুরগির রোস্টের থেকে অনেকটাই আলাদা।

রেসিপি:

উপকরণ:

  • আস্ত মুরগি (চামড়াসহ বা চামড়া ছাড়া): ১টি (মাঝারি আকারের)
  • পেঁয়াজ বাটা: ১/২ কাপ
  • আদা-রসুন বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • টক দই: ১/২ কাপ
  • পোস্তদানা বাটা: ১ টেবিল চামচ
  • বাদাম বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • মরিচ গুঁড়া: ১ চা চামচ
  • হলুদ গুঁড়া: ১/২ চা চামচ
  • ঘি ও তেল: পরিমাণমতো
  • লবণ: স্বাদমতো
  • পেঁয়াজ বেরেস্তা: ১/২ কাপ
  • কিশমিশ ও আলু বোখারা: কয়েকটি
  • গরম মসলা (এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ): কয়েকটি

প্রস্তুত প্রণালী: ১. মুরগি ভালোভাবে পরিষ্কার করে ছুরি দিয়ে কয়েকটি জায়গায় চিরে দিন যাতে মসলা ভেতরে প্রবেশ করে। ২. টক দই, আদা-রসুন বাটা, পোস্তদানা-বাদাম বাটা, হলুদ-মরিচ গুঁড়া ও লবণ একসাথে মিশিয়ে মুরগির গায়ে ভালোভাবে মাখিয়ে ১-২ ঘণ্টা মেরিনেট করুন। ৩. কড়াইতে তেল ও ঘি গরম করে গরম মসলার ফোড়ন দিন। ৪. এবার মেরিনেট করা মুরগি দিয়ে মাঝারি আঁচে ভাজতে থাকুন। ৫. মুরগির সব দিক সোনালি হয়ে এলে বাকি মেরিনেশনের মসলা এবং সামান্য পানি দিয়ে ঢাকনা দিয়ে দিন। ৬. মুরগি সেদ্ধ হয়ে ঝোল ঘন হয়ে এলে পেঁয়াজ বেরেস্তা, কিশমিশ, আলু বোখারা দিয়ে কিছুক্ষণ দমে রাখুন। ৭. তেল উপরে ভেসে উঠলে নামিয়ে পোলাও বা বিরিয়ানির সাথে পরিবেশন করুন।

৪. নোনা ইলিশ: ইলিশের এক ভিন্ন স্বাদ

ইলিশ মাছ বাঙালির প্রিয়, কিন্তু চট্টগ্রামের নোনা ইলিশের কদর একেবারেই আলাদা। লবণ দিয়ে সংরক্ষিত এই ইলিশের স্বাদ সাধারণ ইলিশের থেকে অনেকটাই ভিন্ন এবং তীব্র।

নোনা ইলিশের প্রস্তুত প্রণালী:

ইলিশ মাছের পেট পরিষ্কার করে তার ভেতরে প্রচুর পরিমাণে লবণ ভরে রোদে শুকিয়ে বা বিশেষ প্রক্রিয়ায় সংরক্ষণ করা হয়। এই নোনা ইলিশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের তরকারি, বিশেষ করে বেগুন বা কচুর সাথে রান্না করা হয়, যা স্বাদে আনে এক নতুন মাত্রা।

৫. বেলা বিস্কুট ও মধুভাত: চট্টগ্রামের নিজস্বতা

এই ঝাল এবং মাংসের পদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের কিছু নিজস্ব মিষ্টি এবং হালকা খাবারও রয়েছে। এর মধ্যে বেলা বিস্কুট এবং মধুভাত উল্লেখযোগ্য। বেলা বিস্কুট এক বিশেষ ধরনের শুকনো, মুচমুচে বিস্কুট যা চায়ের সাথে খাওয়া হয়। আর মধুভাত হলো নারকেল, গুড় এবং বিনি চাল দিয়ে তৈরি এক প্রকার মিষ্টি খাবার, যা সকালের নাস্তায় বা হালকা খাবার হিসেবে খুবই জনপ্রিয়।

চট্টগ্রামের খাবারের তালিকা এখানেই শেষ নয়। লইট্টা শুঁটকির ঝাল ঝাল চচ্চড়ি, ছুরি শুঁটকির ভর্তা, কাঁকড়া ভুনা, আখনি বিরিয়ানি - এমন আরও অনেক পদ রয়েছে যা এই অঞ্চলের খাদ্য সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। তাই সুযোগ পেলে অবশ্যই চেখে দেখবেন চট্টগ্রামের এই অসাধারণ সব খাবার।

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url