শেরপুর ভ্রমণ: প্রকৃতির কোলে এক অসাধারণ ছুটি

শেরপুর ভ্রমণ: প্রকৃতির কোলে এক অসাধারণ ছুটি

শেরপুর ভ্রমণ প্রকৃতির কোলে এক অসাধারণ ছুটি

গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সবুজে ঘেরা শেরপুর জেলা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এক অনবদ্য গন্তব্য। মেঘালয়ের সীমান্ত ঘেঁষা এই জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থান এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি পর্যটকদের দেয় এক ভিন্ন মাত্রার অভিজ্ঞতা। যারা শহরের কোলাহল থেকে বেরিয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে কয়েকটা দিন কাটাতে চান, তাদের জন্য শেরপুর হতে পারে আদর্শ ভ্রমণ ঠিকানা

এই ব্লগ পোস্টে আমরা শেরপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং দর্শনীয় টুরিস্ট স্পটগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, যা আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনাকে আরও সহজ করে তুলবে

গজনী অবকাশ কেন্দ্র: পাহাড়, লেক আর সবুজের মিলনমেলা

শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী উপজেলায় অবস্থিত গজনী অবকাশ কেন্দ্র এই অঞ্চলের পর্যটনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। প্রায় ৯০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই কেন্দ্রে প্রকৃতি এবং মানুষের তৈরি নানা স্থাপনার এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে

যা যা দেখবেন ও করবেন:

  • সাইট ভিউ টাওয়ার: ৬৪ ফুট উঁচু এই টাওয়ার থেকে পাখির চোখে পুরো গারো পাহাড়ের সবুজ উপত্যকা এবং মেঘালয়ের পাহাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য উপভোগ করা যায়
  • ঝুলন্ত সেতু ও লেক: এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য রয়েছে স্টিলের ঝুলন্ত সেতু। লেকের শান্ত জলে প্যাডেল বোটে ভেসে বেড়ানো কিংবা ময়ূরপঙ্খী নাওয়ে ভ্রমণ এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা দেবে
  • মিনি চিড়িয়াখানা ও শিশু পার্ক: শিশুদের বিনোদনের জন্য এখানে রয়েছে হরিণ, বানরসহ বিভিন্ন পশুপাখি নিয়ে একটি ছোট চিড়িয়াখানা এবং নানা রাইড সমৃদ্ধ শিশু পার্ক
  • বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর: যারা ইতিহাস ভালোবাসেন, তাদের জন্য রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত নানা তথ্য ও ছবি সংবলিত একটি যাদুঘর
  • অন্যান্য আকর্ষণ: এছাড়াও রয়েছে পাতালপুরী নামক রোমাঞ্চকর সুড়ঙ্গ পথ, কৃত্রিম জলপ্রপাত এবং आदिवासी যাদুঘর

প্রবেশ মূল্য ও সময়সূচী: গজনী অবকাশ কেন্দ্রে জনপ্রতি প্রবেশ ফি প্রায় ২০ টাকা। বিভিন্ন রাইডের জন্য আলাদা টিকেট কাটতে হয়। পার্কটি সাধারণত সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে

মধুটিলা ইকোপার্ক: প্রকৃতির নিবিড় ছায়ায়

নালিতাবাড়ী উপজেলায় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত মধুটিলা ইকোপার্ক আরেকটি চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র। শাল, সেগুন আর বিভিন্ন প্রজাতির গাছে ঘেরা এই পার্কটি জীববৈচিত্র্যে ভরপুর

যা যা দেখবেন ও করবেন:

  • ওয়াচ টাওয়ার: পার্কের উঁচু ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারপাশের সবুজ বনানী আর সীমান্তের ওপারের ভারতীয় পাহাড়ের মনোরম দৃশ্য দেখা যায়
  • স্টার ব্রিজ ও লেক: এখানকার লেকের উপর নির্মিত স্টার ব্রিজটি পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয়। লেকে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগও রয়েছে
  • শোভাবর্ধনকারী ও ঔষধি গাছের বাগান: প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য এখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুল ও ঔষধি গাছের বাগান
  • হাতির ভাস্কর্য: পার্কের প্রবেশমুখে বিশাল আকৃতির দুটি হাতির ভাস্কর্য পর্যটকদের স্বাগত জানায়

রাজার পাহাড়: মেঘে ঢাকা সবুজ টিলা

শ্রীবরদী উপজেলায় অবস্থিত রাজার পাহাড় শেরপুরের আরেকটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান। ঢেউফা নদীর তীরে অবস্থিত এই পাহাড়টি সবুজের চাদরে মোড়া। বর্ষাকালে মেঘ আর পাহাড়ের লুকোচুরি খেলা দেখার জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। তুলনামূলকভাবে নিরিবিলি হওয়ায় যারা শান্ত পরিবেশে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য রাজার পাহাড় ভ্রমণ এক দারুণ অভিজ্ঞতা হবে

পানিহাটা-তারানি পাহাড়: যেখানে নদী আর পাহাড় মিলেমিশে একাকার

নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নে অবস্থিত পানিহাটা-তারানি পাহাড় এক কথায় অনবদ্য। এর একপাশে ভারতের মেঘালয়ের তুরা পাহাড় এবং অন্য পাশে স্বচ্ছ পানির ভোগাই নদী। নদীর টলটলে পানির নিচে নুড়ি পাথরের খেলা আর সবুজ পাহাড়ের সারি মনকে প্রশান্ত করে তোলে। এখানে একটি খ্রিস্টান মিশন, স্কুল ও ছোট একটি চিকিৎসাকেন্দ্রও রয়েছে

ঐতিহাসিক স্থানসমূহ

প্রকৃতির পাশাপাশি শেরপুরে রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ববহনকারী স্থান

  • শের আলী গাজীর মাজার: যাঁর নামানুসারে শেরপুর জেলার নামকরণ, সেই শেষ মুসলিম জমিদার শের আলী গাজীর মাজার এখানে অবস্থিত। প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে এখানে বার্ষিক ওরশ ও গ্রামীণ মেলা অনুষ্ঠিত হয়
  • পৌনে তিন আনী জমিদার বাড়ি: শেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি গ্রিক ও ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। এর কারুকার্যখচিত স্তম্ভ, চুন-সুরকির দেয়াল আর রংমহল আপনাকে পুরনো দিনের জমিদারি ঐতিহ্যের কথা মনে করিয়ে দেবে

শেরপুরের বিখ্যাত খাবার

ভ্রমণে এসে স্থানীয় খাবারের স্বাদ না নিলে ভ্রমণ অপূর্ণ থেকে যায়। শেরপুরের বিখ্যাত "ছানার পায়েস" আপনার রসনাকে তৃপ্ত করবে। এটি সম্প্রতি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের মর্যাদাও পেয়েছে। এছাড়াও এখানকার মণ্ডা, দই এবং বিভিন্ন ধরনের পিঠা বেশ জনপ্রিয়

কিভাবে যাবেন ও কোথায় থাকবেন

যাতায়াত: ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বিভিন্ন এসি/নন-এসি বাসে করে সরাসরি শেরপুর জেলা শহরে পৌঁছাতে পারেন। সময় লাগবে প্রায় ৪ থেকে ৫ ঘন্টা। শেরপুর শহর থেকে সিএনজি, অটোরিকশা বা লোকাল বাসে করে সহজেই গজনী, মধুটিলা ও অন্যান্য দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাওয়া যায়

আবাসন: শেরপুর শহরে থাকার জন্য হোটেল সম্পদ প্লাজা, কাকলী গেস্ট হাউজ, বর্ণালী গেস্ট হাউজসহ বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। গজনী অবকাশ কেন্দ্রের কাছেও বনরাণী ফরেস্ট রিসোর্টের মতো থাকার ব্যবস্থা আছে, যা আগে থেকে বুকিং দিয়ে যাওয়াই ভালো

শেরপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো নিঃসন্দেহে আপনার ভ্রমণকে স্মৃতিমধুর করে তুলবে। তাই পরবর্তী ছুটির পরিকল্পনায় অনায়াসেই রাখতে পারেন এই সুন্দর জেলাটিকে

  

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url